AI কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?

মানুষের মস্তিষ্ক এবং ক্যালকুলেটরের মধ্যে যদি গণনার প্রতিযোগিতা হয়, তবে নিঃসন্দেহে জয়ী হবে ক্যালকুলেটর। কারণ এটি দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারে। এই উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্র মানুষের চেয়ে বেশি দক্ষ। এই দক্ষতার কারণেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত সব জায়গায় যন্ত্রের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বয়ংক্রিয় রোবটগুলো এখন এমন সব কাজ করছে, যা আগে শুধু মানুষই করতে পারত।

যন্ত্র কীভাবে কাজ করে?

যন্ত্র বা রোবট আসলে কীভাবে কাজ করে, এ প্রশ্ন অনেকের মনেই আসে। সহজ ভাষায় বললে, প্রতিটি যন্ত্রের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম দেওয়া থাকে, যার নির্দেশ অনুযায়ী সেটি কাজ করে। তবে যন্ত্র নিজে থেকে চিন্তা করতে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে এমন কিছু প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে, যা যন্ত্রকে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে তুলছে। এই প্রযুক্তির নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence – AI)

AI কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?

AI এমন একটি প্রযুক্তি, যা মানুষের মতো চিন্তা করতে, সিদ্ধান্ত নিতে এবং শেখার মাধ্যমে নিজেকে উন্নত করতে পারে। AI একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সিস্টেম, যা ডেটা এবং অ্যালগরিদমের সাহায্যে কাজ করে এবং সময়ের সঙ্গে আরও বেশি দক্ষ হয়ে ওঠে।

AI-এর ধারণা নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে AI নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে মনোবিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্ল্যাট প্রথম নিউরাল নেটওয়ার্ক “পারসেপট্রন” তৈরি করেন, যা পুরুষ ও মহিলার মুখ আলাদা করতে পারত। এরপর AI-এর ক্ষেত্রে একের পর এক অগ্রগতি ঘটে। ১৯৮৬ সালে তৈরি হয় প্রথম স্ব-চালিত গাড়ি এবং ১৯৯৪ সালে ইয়ান লেকুন এমন একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন, যা হাতে লেখা সংখ্যা শনাক্ত করতে পারত।

AI-এর শিখন পদ্ধতি: মেশিন লার্নিং

AI মূলত মেশিন লার্নিং (Machine Learning) নামক একটি পদ্ধতির মাধ্যমে শেখে। এটি মূলত তিনটি পদ্ধতিতে কাজ করে:

  1. সুপারভাইজড লার্নিং (Supervised Learning):
    এই পদ্ধতিতে মেশিনকে উদাহরণ দেখিয়ে শেখানো হয়। যেমন, হাজার হাজার গাড়ির ছবি দেখিয়ে যদি প্রতিটিকে “গাড়ি” হিসেবে লেবেল করা হয়, তবে ভবিষ্যতে যেকোনো নতুন গাড়ির ছবি দেখে মেশিন চিনে নিতে পারবে।
  2. আনসুপারভাইজড লার্নিং (Unsupervised Learning):
    এখানে মেশিনকে কোনো লেবেল দেওয়া হয় না। এটি নিজেই ডেটার ভেতরের মিল-অমিল বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন দলে ভাগ করে নিতে শেখে। যেমন, যদি মানুষ ও গরুর ছবি একত্রে দেওয়া হয়, মেশিন ছবির বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে আলাদা করে ফেলবে।
  3. রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং (Reinforcement Learning):
    এই পদ্ধতিতে মেশিন নিজের ভুল থেকে শেখে। যেমন, দাবা খেলার সময় মেশিন নিজের সাথেই খেলে, ভুলগুলো শনাক্ত করে এবং ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়ায়।

AI-এর বাস্তব প্রয়োগ ও সাফল্য

AI এখন এমন সব কাজ করতে পারছে, যা একসময় কল্পনার বিষয় ছিল। ২০১৬ সালে AI-ভিত্তিক একটি প্রোগ্রাম “আলফাগো” চীনের প্রাচীন বোর্ড গেম “গো”-তে বিশ্বসেরা খেলোয়াড় লি সেডল-কে পরাজিত করে। এটি AI-এর ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী সাফল্য।

AI বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে:

  • স্বাস্থ্যসেবা: রোগ শনাক্তকরণে
  • গাড়ি চালনা: স্বচালিত যান তৈরি করতে
  • কাস্টমার সার্ভিস: চ্যাটবট বা ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্টে
  • শিল্পে: রোবটিক্স ও স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থায়
  • নিরাপত্তা: ফেস রিকগনিশন ও নজরদারিতে

AI নিয়ে শঙ্কা ও সম্ভাবনা

যদিও AI আমাদের জীবনকে সহজ ও গতিশীল করে তুলেছে, তবুও এর কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন:

  • ডেটা নিরাপত্তা: AI-এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরির আশঙ্কা রয়েছে।
  • চাকরি হারানোর আশঙ্কা: অনেক পেশা যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে।
  • প্রতারণা ও হয়রানি: Deepfake বা AI-ভিত্তিক প্রতারণামূলক কনটেন্ট তৈরি হতে পারে।

তবে এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ AI এখনো মানুষসদৃশ বুদ্ধি বা চেতনা অর্জন করেনি। এটি কেবলমাত্র ডেটা ও অ্যালগরিদম অনুযায়ী কাজ করে। AI আমাদের তৈরি, এবং এর নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতেই।

উপসংহার

AI একটি অসাধারণ প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, যা আমাদের জীবন, কাজ ও চিন্তাভাবনার ধরণ বদলে দিচ্ছে। এটি যেমন সুযোগ তৈরি করছে, তেমনই কিছু চ্যালেঞ্জও আনছে। তাই AI-এর নৈতিক ও দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। ভবিষ্যতে AI আরও বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর হবে, তবে তার দিকনির্দেশনা মানুষের মূল্যবোধ ও বিবেচনার উপরই নির্ভর করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top